রুদ্র সাইফুল: ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফ, মুখে দাঁড়ি, চোখে বিষন্নতা, অবিন্যস্ত লম্বা চুলের ওপর চ্যাপ্টা গোল টুপি। একনজরেই বলে দেওয়া যায়, এই মানুষটি আর দশটা মানুষ থেকে একেবারেই ভিন্ন। অন্যায়, নিপীড়ন আর শোষণবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে তাঁর ছবি। ভেঙে দেয় দেশকালের সীমা। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর মার্কিন বংশবদ প্রতিক্রিয়াশীলদের গুলিতে নিহত হয়েছেন এই মানুষটি। বুঝতেই পারছেন, বিপ্লবের বরপুত্র আর্নেস্তো চে গুয়েভারার কথা বলছি। যিনি আজও চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।
আর্নেস্তো গুয়েভারা ডেলা সেরনা। দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের উজ্জ্বল স্বাক্ষরে শুধুই পরিচিত নাম ‘চে’। জীবন জয়ের সংগ্রামী ধ্রুবতারা, আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ও ডে লা সেরনার গর্ভের সন্তান। ১৯২৮ সালের ১৪ জুন পৃথিবীর আলোয় উদ্ভাসিত হন। ১৯৫২ সালে বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ডাক্তার হয়েই পুরো লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রাম উপলদ্ধির জন্য পরিভ্রমণ করেন।
১৯৫৪ সালে সিআইএ পরিচালিত এক সামরিক অভিযানে গুয়াতেমালার জাকাবো আরবেনজের নির্বাচিত সরকারের উৎখাত সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী এই বিপ্লবী। রাজনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে তার উপর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়। গুয়াতেমালা ত্যাগ করে বাধ্য হয়ে মেক্সিকোতে আশ্রয় গ্রহণ করেন চে। কিউবার স্বৈরতন্ত্রী সরকার ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুতের উদ্দেশে নির্বাসিত কিউবার বিপ্লবীরা সেই সময়ে মেক্সিকোতে। সেখানেই বিপ্লবীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং ফিদেল কাস্ত্রোর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়।
১৯৫৫ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড় থেকে কিউবার বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় কিউবান বিপ্লবীদের সঙ্গী এবং চিকিৎসক। ১৯৫৭ সালের জুলাইতে সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রথম কমান্ডার হন। ১৯৫৯ সালে তীব্র সংগ্রামী লড়াইয়ে বাতিস্তা সরকারের পতন হয়। চে তখন নতুন বিপ্লবী সরকারের অন্যতম নেতা। এরপর হন জাতীয় ভূমি সংস্কার ও শিল্প দপ্তরের প্রধান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভাপতি, শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী।
১৯৬৫ সালে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে সারা পৃথিবীজুড়ে কিউবার প্রতিনিধিত্ব করেন। আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও রাষ্ট্রপুঞ্জে কিউবার প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে অন্যান্য দেশের মুক্তির সংগ্রামে স্বশরীরে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে কিউবা ত্যাগ করেন। কিছু সময় আফ্রিকার কঙ্গোতে অবস্থান এবং পরে ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যবস্থাপনায় গোপনে কিউবায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৬৬ সালের নভেম্বরে বলিভিয়ার নিপীড়িত মানুষের জীবনযুদ্ধে ছদ্মবেশে বলিভিয়ায় প্রবেশ করে কিউবান বিপ্লবী ও বলিভিয়ার নিপীড়িত মানুষদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন ও বলিভিয়ার সামরিক সরকারের উৎখাতের জন্য গেরিলা অভিযান শুরু করেন। একের পর এক সফল অভিযানে সারা বিশ্ব যখন আন্দোলিত।
সেই সময় ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বংশবদ প্রতিক্রিয়াশীল বলিভিয়ান সামরিক বাহিনীর হাতে আহত এবং ৯ অক্টোবর ওয়াশিংটনের নির্দেশে সরাসরি গুলির আদেশে নিহত হন এই মহান বিপ্লবী।
যুগে যুগে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের প্রতীক এখন চে গুয়েভারা। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে দেশে দেশে লড়াই করেছেন এই বীর। চে কে দেখা হয় সব দেশে সব কালের প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে।